- সাগর আল হেলাল
- হাবলুর বাচ্চা কয় কি ! নিচের ঠোঁটে চুমা দিবো। উপরের ঠোঁটের চুমায় মন ভরে না। রানের নিচে চাইপা যদি তোর জান কবচ না করিচি, তো আমার নামও চুমকী না। ঐ ভাওরা, রাখ। টেলিফোন রাখিস না ক্যা ? মনে করচস, আমি লাইন কাটুম, কক্ষণো না। দেখপার চাই তুই কতো সইতে পারিস ?
মোবাইলের লাইন না কেটে টেবিলের উপর সেটা রেখে হাঁফ ছাড়ে চুমকী। আজ মাথা খুব গরম হয়ে গেছে। গতকাল বিকেলে দেখা করার কথা ছিলো সুজনের। কাজের অজুহাত দিয়ে আসেনি সে। সেই ঝাল তুলছে চুমকী। ওপাশে সুজন চোখ-কান বন্ধ করে মোবাইলটা কান থেকে একটু দূরে সরিয়ে শুনছে চুমকীর খিস্তি খেওর। লাইন কেটে দিলে আরও ক্ষেপে যাবে। ফোনটা সে-ই করেছে। অগত্যা নিরবে হজম করছে সব। একটু জিরিয়ে আবারও মোবাইল তুলে নেয় চুমকী।
- কি, সাহস হইলো না লাইন কাইট্যা দেওয়ার ? বিএ পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট কইরা দেমাগ বাড়ছে ? কয়জনের সাথে ফষ্টি-নষ্টি তোর ? এই, কথা কস্ না ক্যা ? বোবা হইচছ ? মুখে তালা মারছে কে ?
ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসবে না, এ কথা চুমকী জানে। তবুও একটু সাপলুডু খেলছে আর কি। মনের জ্বালা, কঠিন জ্বালা। আবার কথা শুরু করে সে-
- শোন, মায় ডাকছে। হের লাইগা রাখছি। মা-ডা যে কি ! জরুরী কামে খালি ডিসটার্ব করে। মার কথা শুইনা, তারপর ফোন দিতাছি। ফোন বন্ধ রাখবি না কিন্তু। তাইলে খবর আছে।
নিজেই ফোনের লাইনটা কেটে দিলো চুমকী।
রাগটা সামান্য কমেছে। তার মা তাকে ডাকে নি। সে স্কুলে গেছে ছোটো ভাইকে আনতে। সে
বাড়িতে থাকলে এতো জোরে এসব কথা সে বলতে পারতো না। খাটে পা ঝুলিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে
পড়ে। বুকের উপর বনবন করে সর্বোচ্চ গতিতে ঘুরছে ফ্যান। তবুও কপালের ঘাম শুকাতে আরও
কিছু সময় লাগবে বলে মনে হয়। চুমকী চোখ বন্ধ করে।
চোখ খুলেই দরজায় চুমকীকে দেখে লাফিয়ে ওঠে সুজন। এক হাতে চোখ রগড়ায়, আরেক হাতে মোবাইল হাতড়ায়। দেখতে চায় মোবাইলে চুমকীর মিসকল আছে কি না। মোবাইলে চোখ রাখতেই চুমকী বলে ওঠে-
- কারো ফোন করার কথা ছিলো নাকি ?
- না, দেখছিলাম, তুই ফোন করেছিস নাকি।
- না, দেখছিলাম, তুই ফোন করেছিস নাকি! মুখ ভেঙচিয়ে বলে চুমকী। তারপর, আবার বলে- আমার ফোন করতে বয়ে গেছে। কার ফোনের অপেক্ষায় ছিলি তুই ?
সুজন বুঝতে পারে, রাগটা কমে গেলেও তাপটা এখনো আছে। এ সময় আমতা আমতা করলে কাজ হবে না। মা বাড়িতে আছে। চুমকী বেশি সুবিধে করতে পারবে না। থিওরি, পাল্টাতে হবে। তাই সে বলে-
- এই, তোরে আমি চুমা দিয়েছি কবে ?
- আমি কি মানা করেছি নাকি ?
চুমকীর গালদুটো লাল হতে দেখে সুজন। সে বোকা হয়ে গেছে। মা বাড়িতে। কি করা যায় ! চুমকী আবার বলো-
- উঁহ্, চুম্মা খাইবো ! দেবো এক বাড়ি। এটা ধর, মা দিয়েছে। দেশী গুড় দিয়ে বানিয়েছে। নিজের মেয়ের কোনো সাধ আহ্লাদ পূরণে খবর নাই, বইনের ছেলের জন্য নাড়ু বানায়। ধর। ধমকের সুরে বলে চুমকী।
চুমকীর হাত থেকে বক্সটা নিতে নিতে সুজন বলে-
- এইসব খিস্তি খেওর কার কাছ থেকে শিখেছিস ?
- ওস্তাদ ধরছি। তাতে তোর কি ! আমি খালার কাছে যাচ্ছি।
নাড়ুর বক্স হাতে নিয়ে সুজন চুমকীর
যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, চুমকী কি চায় সে তাকে চুমা দিক ? সুজনের
মাথায় কুলায় না। প্রিয় গুড়ের নাড়ুর দিকে মন দেয়। মায়ের কান্নার আওয়াজ কানে আসে।
চুমকীকে দেখলেই মা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ২৮ অক্টোবর লগি বৈঠার মিছিলের সামনে পড়েছিলো
ছোটো খালু। অফিস থেকে ফিরছিলেন তিনি। এমন মিছিল হবে সেকথাও জানতেন না। চাকরীতে
অল্প কিছুদিন আগেই ভালো একটা প্রোমোশন পেয়েছিলেন। অনেক বেতন পেতেন। ডাক্তাররা অনেক
চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারে নি। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিলো। রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানবতাবিরোধী অপরাধ। এই দিনে এ দেশের রাজনীতির
ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায় রচিত হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে তরতাজা মানুষকে
পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে নারকীয় উল্লাস চালানো হয়েছিল।
ছোটো বোন অল্প বয়সে বিধবা হওয়ায় মা
খুব কষ্ট পেয়েছে। বোনের সামনে কাঁদলে, সেও কাঁদে। দুঃখটা দ্বিগুণ হয়। সেই কান্না
বোনের মেয়ের সামনে কেঁদে মন হালকা করে। সুজন জানে, মিনিট পাঁচেক না গেলে মা শান্ত
হবে না। হাত-মুখ না ধুয়েই কতকটা নাড়ু খেয়ে ফেলেছে সে। তারপর ভাবে, চুমকী হয়তো
বেরুতে চাইবে। গোসলখানায় ঢোকে তাড়াতাড়ি।
গোসলখানায় ঢুকে প্রথমেই সেভ করে। মাউথ
ওয়াশ দিয়ে মুখ পরিস্কার করতে করতে আওড়ায়- উপর ঠোঁটে চুমা খেয়েছি আমি। আমাকে রানে
নিচে ফেলে চাইপা জান কবচ করবে। আমি নিচের ঠোঁটে চুমা খেতে চেয়েছি। আজ তোর নিস্তার
নেই চুমকী, আজ তোর নিস্তার নেই। আজ তোর দুই ঠোঁট একসাথে চাবায়া খাবো। আচ্ছা মতো
সাবান ঘসে সমস্ত শরীরে। গোসল সেরে বাইরে এসে কারো কোনো সাড়া পায় না সুজন। ভাবে,
বোনঝির সাথে গল্পে মজে গেছে মা।
ফ্যানটা দ্রুতবেগে ছেড়ে দেয়। ফেস কাপড়
চোপড় পরে। শরীরে শুধু নয়, সারা ঘর সেন্ট মেরে সুগন্ধিতে ভরে দেয়। সিডি প্লেয়ারে
একটা রোমান্টিক গান প্লে করে। মাত্র দুইটা মিনিট সময় পেলেই আজ কাজটা সেরে ফেলবে।
সিডির গানের সাথে নিজেও গুনগুন করে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায়, নিজের ঠোঁটের
দিকে তাকায়। তাকে খুব ক্ষুধার্ত দেখা যাচ্ছিলো।
নিঃশব্দে রুমে ঢুকেছে চুমকী। রুমের আবহাওয়া বুঝতে পেরেছে সে। দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। সুজন আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়েই দেখতে পায় চুমকীকে। মুচকী মুচকী হাসছে সে। কিন্তু ঘরের ভেতরে ঢুকছে না। কি ভাবছে সে ? চোখে আবেগ নিয়ে তাকায় সুজন। দু’জন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। দুটি তৃষ্ণার্ত প্রাণ, ঘরময় সুগন্ধিতে ভরা, সিডি প্লেয়ারে বেজে চলেছে রোমান্টিক গান। শুধুমাত্র দূরত্ব কমার অপেক্ষা। সুজনের পা সামনের দিকে চলতে থাকে। চুমকী দরজায় ঠেঁস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাস্যরত। সুজন অগ্রসরমান। হঠাৎ চুমকী চেঁচিয়ে ওঠে-
- ও খালা, দেখো তোমার ছেলে কি করতাছে ?
সুজন হকচকিয়ে ওঠে। কি করবে বুঝতে পারে না। এরই মধ্যে মা এসে পড়েছে। সুজনকে লক্ষ করে বলে-
- কি করেছিস ? সুজন কিছু বলে না। চুমকীর দিকে তাকিয়ে বলে-
- কি করেছে ?
- আমি এসে দেখি আপনের ছাওয়াল বিড়ি খাচ্ছে। আমাকে দেখেই সেন্টের বোতল খালি করে ঘর থেকে গন্ধ তাড়াচ্ছে।
এ কথা শুনে সুজনের মা কাঁদতে কাঁদতে
খেদোক্তি করতে আরম্ভ করে। বলে- সবই আমার কপাল। এই জন্যি আমি কই, ঘরের দরজা বন্ধ
কইরা আমার ছাওয়াল কি করে। কতো কি ভাইবা রাখছি -- - - -
পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সুজন। মায়ের কোনো কথা তার কানে যায় না। দরজায় দাঁড়ানো চুমকী মা-কে এড়িয়ে সুজনের দিকে একটি ফ্লাইং কিস্ ছুঁড়ে দেয়। বলে-
- খালা, আমি যাচ্ছি। তোমাগে মায়-পুতের ভিতরে আমি ঢুকপার চাই না।
No comments:
Post a Comment