=================================
লিটল ম্যাগাজিন পরমাণু অস্ত্রের মতো। আকারে ক্ষুদ্র হলেও অনেকগুলো প্রতিভাবান ও উদীয়মান লেখকের প্রতিনিধিত্ব করে লিটল ম্যাগ। উদীয়মান সাহিত্যিকদের নিজ প্রতিভার স্যাম্পল দেখানোর যেই সুযোগ লিটল ম্যাগাজিনে আছে, তা অন্য আর কোন প্রচার মাধ্যমে নেই। মির্জা রানা সম্পাদিত ও পাবনা থেকে প্রকাশিত ‘তূর্য নিনাদ’ লিটল ম্যাগাজিনটি উদীয়মান কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিভা প্রদর্শন তথা সমাজের অনিয়ম অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার এক অন্যতম মাধ্যম হিসেবে প্রমাণ রেখে চলেছে।
’তূর্য নিনাদ‘ লিটল ম্যাগ নিয়ে আলোচনার আগে আমরা জেনে আসি লিটল ম্যাগ বা লিটল ম্যাগাজিন কি? লিটল ম্যাগকে বাংলায় বলা হয় ছোট কাগজ। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে লিটল ম্যাগাজিনের প্রচার ও প্রসার ঘটলেও এর উৎপত্তি উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। Ralph Waldo Emarson Fuller সম্পাদিত The Dail (Boston, 1840-1844) পত্রিকাটি লিটল ম্যাগাজিনের আদিরূপ হিসেবে ধরা হয়। আর পত্রিকা শব্দটি ম্যাগাজিন শব্দরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৩১ সালে এডওয়ার্ডকেভ সম্পাদিত Gentleman’s Magazine প্রকাশের মধ্য দিয়ে। Magazine অর্থ বারুদশালা। বারুদ ঠাসার মতোই শব্দ-অক্ষরের মজুদের আধার হিসেবে ম্যাগাজিন শব্দের এই প্রতীকী ব্যবহারই পরবর্তীতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও শুধুমাত্র বাঁধানো পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রেই ‘ম্যাগাজিন’ শব্দটি ব্যবহার হতো। তবে ‘লিটল ম্যাগাজিন’ নামের এই যুগ্ম শব্দের ব্যবহার আঠারো শতকের শেষ দশকে বা উনিশ শতকের প্রথম দশকে ইউরোপে শুরু হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়। বিরাট বাজেটের পণ্যসর্বস্ব সাহিত্যের বিপরীতে বিশেষ রীতির পত্রিকাকেই ‘লিটল ম্যাগাজিন’অভিধায় চিহ্নিত করা হয়।
প্রকৃত অর্থে লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র হচ্ছে প্রতিবাদী ও তথাকথিত প্রতিষ্ঠানবিরোধী। আর তাই প্রথাবিরোধী মেধাবী সৃজনশীলদের সাহিত্যচর্চার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে এই লিটল ম্যাগাজিন। এর মাধ্যমেই সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি, তরুণ লিখিয়েদের আনকোরা উপস্থাপন ও সাহিত্যের নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে। আমাদের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পর্ক এক কথায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। তাই লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনা আসলেই বাংলাভাষার অন্যতম খ্যাতিমান লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর নামটিও অবিচ্ছেদ্যভাবেই চলে আসে। চারিত্র্য বিশ্লেষণে লিটল ম্যাগাজিনের স্বরূপ কী হবে এ ব্যাপারে তাঁর ব্যাখ্যাকে মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ‘দেশ’ পত্রিকার মে ১৯৫৩ সংখ্যায় ‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন- ‘এক রকমের পত্রিকা আছে যা আমরা রেলগাড়িতে সময় কাটাবার জন্য কিনি, আর গন্তব্য স্টেশনে নামার সময় ইচ্ছে করে গাড়িতে ফেলে যাই- যদি না কোনো সতর্ক সহযাত্রী সেটি আবার আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বাধিত এবং বিব্রত করেন আমাদের। আর এক রকমের পত্রিকা আছে যা স্টেশনে পাওয়া যায় না, ফুটপাতে কিনতে হলেও বিস্তর ঘুরতে হয়, কিন্তু যা একবার হাতে এলে আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি না, চেয়ে-চেয়ে আস্তে আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ন্যাপথলিন-গন্ধী তোরঙ্গে তুলে রাখি জল, পোকা আর অপহারকের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য। যে সব পত্রিকা এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত হতে চায়- কৃতিত্ব যেইটুকুই হোক, নজরটা যাদের উঁচুর দিকে, তাদের জন্য নতুন একটা নাম বেরিয়েছে মার্কিন দেশে; চলতি কালের ইংরেজি বুলিতে এদের বলা হয়ে থাকে লিটল ম্যাগাজিন।” বুদ্ধদেব বসু’র এই ব্যাখ্যা থেকেই লিটল ম্যাগাজিন কী, কেন এবং গড়পরতা সাহিত্য-সংকলনপত্রের সাথে এর পার্থক্য কোথায় কীভাবে, তার একটা মোটামুটি রেখাচিত্র অংকিত হয়ে যায়। কণ্ঠস্বর-সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন- “লিটল ম্যাগাজিন বলতে বুঝি যেটা সাহিত্যের নতুন পালাবদলকে ধারণ করে। যে কাগজের ভেতর দিয়ে সাহিত্য নতুন পণ্যের দিকে পা দেয়-এটাকে বলে লিটল ম্যাগাজিন।”
লোকায়ত-সম্পাদক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন- বাংলা ভাষায় ইংরেজির প্রভাবে লিটল ম্যাগাজিন কথাটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু ১৯৫০-এর দশকে। কিন্তু তখনি এটা প্রচলন লাভ করেনি। কি বাংলায়, কি ইংরেজিতে কথাটা সকলে এক অর্থে ব্যবহার করেননি। কেউ জোর দিয়েছেন প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, প্রথাবিরোধিতায়। কেউ জোর দিয়েছেন নতুনত্বে। কেউ জোর দিয়েছেন সৃজনশীলতায়। কেউ কেবল ভাঙতে চেয়েছেন, কেউ গুরুত্ব দিয়েছেন নবসৃষ্টিতে। কারো দৃষ্টি কেবল বর্তমানে, কারো দৃষ্টি ভবিষ্যতের দিকে। গতানুগতিতে অনীহ সকলেই। আমি মনে করি- লিটল ম্যাগাজিনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার সৃষ্টিশীলতায় ও নবসৃষ্টির আন্দোলনে। লিটল ম্যাগাজিন নবচেতনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে এবং লেখক ও পাঠকদের মাধ্যেমেই নব চেতনাকে সঞ্চারিত করে দেওয়ার জন্য আন্দোলনে যায়। শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিনগুলো নতুন সাহিত্য আন্দোলনের মুখপত্র। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, সমাজচিন্তা, বিজ্ঞান ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই লিটল ম্যাগাজিন হতে পারে- হয়ে থাকে।”
যথার্থ লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরু হয় মূলত প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র (১৯১৪) দিয়ে। তারপর একে একে কল্লোল (১৯২৩), সওগাত (১৯২৬), শিখা (১৯২৭), কালি কলম (১৯২৭), প্রগতি (১৯২৭), পরিচয় (১৯৩১), পূর্বাশা (১৯৩২), কবিতা (১৯৩৫), চতুরঙ্গ (১৯৩৮), শনিবারের চিঠি (১৯২৪) ইত্যাদি।
পরবর্তীকালে আমাদের সাহিত্যে বলা চলে লিটল ম্যাগাজিনের জয়জয়কার। রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা থেকে প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে, যা আমাদেরকে নতুন নতুন চিন্তাচেতনায় ও সৃষ্টিপ্রবণতায় উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। ছোটগল্প, সংস্কৃতি, লোকায়ত, রূপম, কিছুধ্বনি, একবিংশ, বিপ্রতীক, লিরিক, নিসর্গ, ঊষালোকে, উটপাখি, অলক্ত, প্রান্ত, ১৪০০, সুদর্শনচক্র, দ্রষ্টব্য, প্রাকৃত, শিকড়, বিবর, চালচিত্র, ছাপাখানা, জীবনানন্দ, প্রতিপদ, নান্দনিক, দ্বিতীয় চিন্তা, মধ্যাহ্ন, দ্রাবিড়, শুদ্ধস্বর, পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বাতন্ত্র্য, মঙ্গলসন্ধ্যা, প্রতিশিল্প, সুমেশ্বর, বিবিধ, পত্তর, শব্দশিল্প, শব্দপাঠ, নন্দন, ঋতপত্র, সমুজ্জ্বল সুবাতাস, ব্যাস, লোক, অক্ষর, ধাবমান, কর্ষণ, নান্দী, কালনেত্র, কবিতাপত্র, এণ্টিকক, সময়কাল, লাস্টবেঞ্চ ১১৫, মেইনরোড, ঘুড্ডি, গুহাচিত্র, বুকটান, সুনৃত, বিবিক্ত, পরাবাস্তব, উল্লেখ, উলুখাগড়া, শতদ্রু, লেখাবিল, চিহ্ন, জলসিঁড়ি, পর্ব, কোরাস, বেহুলা বাংলা, চর্যাপদ, কহন, অ, কালধারা, পুণ্ড্র, অভীপ্সা, নৃ, যুক্তি, ধীস্বর, বৃক্ষ, পোয়েট-ট্রি, তৃণমূল প্রভৃতি লিটল ম্যাগাজিন উল্টো স্রোতের কুলঠিকানা খুঁজে পাওয়ার ধারাবাহিকতার অংশ।
এই প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় যুক্ত হয়েছে আরও একটি নাম ‘তূর্য নিনাদ’। লিটল ম্যাগাজিনের মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে নতুন সূর্য আলোর উন্মেষে স্লোগান নিয়ে মুনাফা লুট বা যেন তেন ভাবে পাঠকগোষ্ঠীকে করায়ত্ব করার পথ বেছে না নিয়ে সৃজনশীলতার পথে এগিয়ে যাচ্ছে দৃপ্ত পদক্ষেপে মির্জা রানা ও তূর্য নিনাদ।
দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা এপ্রিল ২০১৮ বই সাইজে ১৪৪ পৃষ্ঠার তূর্য নিনাদ প্রকাশ করেছেন সাকী রেজওয়ানা কথা। ১১টি প্রবন্ধ, ৪টি গল্প এবং এক ঝাঁক সৃজনশীল কবিতা স্থান পেয়েছে বর্তমান সংখ্যায়। পত্রিকাটির উপদেষ্টা প্যানেলে রয়েছেন- জাকির হোসেন, সরওয়ার জাহান, মোখলেছ মুকুল, সমীর আহমেদ, আদ্যনাথ ঘোস, সুমন শিকদার প্রমূখ। প্রচ্ছদ অলঙ্করণ করেছেন সম্পাদক নিজেই। মুদ্রণে রংমেলা।
মফঃস্বল পাবনা জেলা শহরের মতো ছোট্ট জায়গা থেকে তূর্য নিনাদ এর মতো এমন হৃষ্টপুষ্ট, তকতকে-ঝকঝকে মলাটের সৃজনশীল একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন প্রকাশ করা কম কথা নয়। লেখা সংগ্রহ থেকে আরম্ভ করে প্রকাশনার প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করা কেবল দুরূহ কাজ নয়, এভারেস্ট বিজয়ের মতো দুঃসাধ্যও বটে। তূর্য নিনাদ সম্পাদক সৃজনশীল লেখা নির্বাচনে নির্মোহ থেকেছেন এবং প্রকাশনার প্রতিটি ধাপেই সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মির্জা রানা জগতজোড়া বৈষম্যের শিকার হওয়া ব্যক্তি, জাতি-গোষ্ঠির পক্ষে সোচ্চার, শোষিত-বঞ্চিত গণমানুষের ব্যথায় তার অন্তর ব্যথিত। ভোগবাদী ভেসে যাওয়া গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে না দিয়ে, সামাজিক মূল্যবোধকে শক্তভাবে ধারণ ও বহন করে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কলমের সাহায্যে গণমানুষের পক্ষে অবদান রেখে চলেছেন মির্জা রানা।
তূর্য নিনাদের এবারের সংখ্যাতেও যথারীতি প্রবন্ধের আধিপত্য বজায় রয়েছে। বেশ কয়েকটি মজবুত শরীরের প্রবন্ধ তূর্য নিনাদের শরীরকেও সুদৃঢ় করেছে। এ সংখ্যায়- “কবিতা সমকালীন, চিরকালীন নয়” প্রবন্ধটি লিখেছেন মজিদ মাহমুদ। মজিদ মাহমুদ নিজেও একজন কবি। লেখাটি পাঠ করে লেখকের অধ্যয়নমনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি তার লেখাটি আরম্ভ করেছেন “বাংলা কবিতা কালোত্তীর্ণ হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে” বাক্যটি দিয়ে। তিনি লিখেছেন- “আধুনিক বাংলা কবিতার যা কিছু টিকবার ক্ষমতা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দের মধ্যে পরিসমাপ্তি ঘটেছে;” আবার লিখেছেন- “কবিতার টিকে থাকার ক্ষমতা তার পাঠকদের বদান্যের ওপর নির্ভর করে আছে।” তিনি বলেন- “পাঠক এবং কবির আদি ও মৌলিক কবিতা লেখা কিংবা পাঠ করার দাবী পরিত্যাগ করা উচিত”। তিনি নজরুল জীবনানন্দকে স্বল্পায়ুর কবি বলেছেন, এবং এ সকল স্বল্পায়ুর কবি বুদ্ধদেব বসুর কল্যাণে বেঁচে আছেন বলে তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। প্রবন্ধটি দুটি পর্বে লিখিত হয়েছে। প্রথম অংশে কবিতার বর্তমান অবস্থা এবং তার ভবিষ্যত নিয়ে, আর দ্বিতীয় অংশে কবিতার অতীত নিয়ে আলোচনা রয়েছে। প্রবন্ধটির ২য় অংশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে যা পাঠ করে পাঠকগণ, বিশেষ করে কবিতার মানুষজন বিশেষভাবে উপকৃত হবেন বলে প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশে সংস্কৃতি-চর্চার চিত্র শিরোনামের অপর প্রবন্ধটি রচনা করেছেন আবিদুল ইসলাম। সৃজনশীল কর্মীদের নিকট থেকে সৃজনশীল শব্দটি বুর্জোয়া রাষ্ট্র কিভাবে সুকৌশলে ছিনতাই করছে তার বিস্তারিত ইঙ্গিত রয়েছে এই প্রবন্ধে। শহীদ ইকবাল রচিত গণসাহিত্য’ বা তথৈবচ কথাপ্রশ্ন শিরোনামের প্রবন্ধটিতেও গণমানুষের কথা সুস্পষ্টভাবেই বর্ণিত হয়েছে। যেমন তিনি লিখেছেন- সমাজে এখন অনেক আসবাবপত্র আছে কিন্তু তা তুমুল অসারত্ব দিয়ে ভরা, চলছে ব্যক্তির উন্মার্গগামীতাও। এই একটি লাইন পাঠ করেই বুঝা যায় লেখাটিতে শ্রেণি বৈষম্যের গভীর ক্ষতের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে সমাজে আজ গোষ্ঠির চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থকে কিভাবে বড়ো করে দেখা হচ্ছে।
এছাড়া, আহমদ জসিম রচিত “একজন বিচারক অথবা একটি ভেঙে পড়া রাষ্ট্রের গল্প, আবু সাঈদ আহমেদ রচিত মানবাধিকারঃ আর কতদূর!, শরীফুজ্জামান আগা খানের বিশ্বাস বনাম চিন্তার শৃঙ্খলা, ড. মো. আব্দুল মজিদ এর জীবন সমাজ ও সংস্কৃতি ঃ আত্ম জিজ্ঞাসার স্বরূপ, মোহাম্মদ আব্দুর রউফ এর নজরুল সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সৈকত মাহমুদের রুশ বিপ্লবের তাৎপর্য, ইফতেখার আহমেদ বাবু রচিত পরিবর্তনের রাজনীতির আকাক্সক্ষা ও বাস্তবতা ও ব্রেন্টিমা চাকমা রচিত পাহাড়ের জীবনচিত্রে “বৈসাবি সংক্রান্তি” প্রবন্ধ নির্বাচন তূর্য নিনাদ সম্পাদক মির্জা রানার সামাজিক চেতনা, ধর্ম নিরপেক্ষ মনোভাবনা, গণমানুষের প্রতি অসীম ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।
আহমদ জসিম তার লেখায় গণমানুষের উপর নিপীড়ন কিভাবে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে তার বিষদ আলোচনা দেখতে পাই। তিনি যথার্থভাবেই মূল্যায়ন করে লিখেছেন যে, “৯০-পরবর্তী সময় ব্যাপারটা আরও ব্যাপক মাত্রা পেয়েছে। জনগণ এক স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে ঠিকই, তবে দুই লুটেরা বুর্জোয়া দল ২৭ বছর ধরে দেশ শাসন করে, স্বৈরাচারী ব্যবস্থা একেবারে তৃণমূলে ছড়িয়ে দিয়েছে।” তিনি আরও লিখেছেন- “এ দেশের সংবিধান অনুসারে এখনও সর্বোচ্চ সম্মানী পদটার নাম রাষ্ট্রপ্রধান হলেও, ওই মসনদে বসার প্রধান যোগ্যতা হলো, আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে দলীয় প্রধানের পদতলে মাথা গুঁজে রাখতে পারা।” লিটল ম্যগাজিনের বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন লেখা তূর্য নিনাদে প্রকাশ করায় সম্পাদক মির্জা রানার অকুতোভয় মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
মানবাধিকার নিয়ে আবু সাঈদ আহমেদ এর লেখাটি খুবই সুপাঠ্য লেগেছে। মানবাধিকারের অনুচ্ছেদ সহকারে বিবরণ পাঠে পাঠক সমাজের অতি পরিচিত শব্দ মানবাধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত হতে পারবেন। লেখাটির সর্বশেষ অনুচ্ছেদটি যেন একজন লিটল ম্যাগাজিনের মানুষকেই ইঙ্গিত করে। পাঠকের জন্য অনুচ্ছেদটি তুলে দিলাম- “অনুচ্ছেদ-২৯ ঃ প্রত্যেকেরই সমাজের প্রতি কর্তব্য রয়েছে, কেবল যার অন্তর্গত হয়েই তার ব্যক্তিত্বের অবাধ ও পূর্ণ বিকাশ সম্ভব”। এই বাক্যটিকে তূর্য নিনাদ ও তার সম্পাদকের সাথে মিলিয়ে দেখলে বুঝা যায়, তূর্য নিনাদ লিটল ম্যাগাজিনটি মানবাধিকার সংরক্ষণে গণমানুষের পক্ষের একটি বিরাট হাতিয়ার।
“একজন জীবনবাদী সংস্কৃতমনা মানুষ পরম বেদনায়, অসংখ্য দুঃখের কাঁটায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে সে অন্তরে যে গোলাপ ফুটিয়ে তোলে তাই তার স্বর্গ।” বাক্যটি লিখেছে ড. মো. আব্দুল মজিদ ওনার জীবন সমাজ ও সংস্কৃতি ঃ আত্ম জিজ্ঞাসার স্বরূপ প্রবন্ধে। তিনি তার লেখার অন্য আরেক জায়গায় লিখেছেন- “সমাজ-সংস্কৃতির উৎস ও উত্তরণের পরিক্রমা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জীবনের বিকাশ ও বিস্তরণশীল পথ পরিক্রমাই অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রেও স্বমহিমা দান করেছে। আর এই স্বমহিমা প্রকাশ ও প্রণয়নরীতিই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার করে।” ড. মো. আব্দুল মজিদ ওনার এই প্রবন্ধে এমন আরও অনেক বাক্য লিখেছেন, যা হৃদয়কে আন্দোলিত করে। এ লেখাটি তূর্য নিনাদকে গণমানুষের মুখপত্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তির পথ প্রশস্ত করেছে। এমন লেখাকে তূর্য নিনাদ লিটল ম্যাগাজিনে স্থান দিয়ে পত্রিকার সম্পাদক মির্জ রানা যথেষ্ঠ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন।
নজরুল সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা শিরোনামে মোহাম্মদ আব্দুর রউফ এর প্রবন্ধটি তূর্য নিনাদ পত্রিকায় স্থান পাওয়ায় পত্রিকাটির অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে আরও মজবুত করেছে। রুশ বিপ্লবের শতবর্ষে রুশ বিপ্লবের তাৎপর্য শিরোনামে সৈকত মাহমুদের লেখা পাঠ করে আমরা রুশ বিপ্লব ও তার পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্রুত উন্নয়নের ইতিহাস জানতে পারি। তূর্য নিনাদে প্রকাশিত ১১টি প্রবন্ধ নির্বাচন ও তা প্রকাশের পদক্ষেপে সম্পাদকের মননশীলতা, গণমানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটেছে। শ্রেণি বৈষম্যহীন মেহনতি মানুষের সমাজ গঠনে শোষিত বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাহস তিনি যথাযথভাবেই দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।
তূর্য নিনাদে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের চারটি গল্প মুদ্রিত হয়েছে। গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তিনি মুন্সীয়ানার ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এ সংখ্যায় গল্প লিখেছেন যারা, তারা হলেন- সুমন শামস্, সাগর আল হেলাল, হাফিজ আল ফারুকী ও মোখলেছ মুকুল। গল্পগুলির ভাষা শৈলী এবং উপস্থাপনা কৌশল সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। পাঠক গল্পগুলি পাঠে কখনো জীবনবোধের পরাবাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে পারবেন, আবার কখনো কল্পনার আকাশ ভ্রমণ করতে পারবেন। কোন গল্পে কসমিক যোগাযোগ তো অন্য গল্পে উপজাতি নৃগোষ্ঠির সামাজিক উৎসব অবলোকন করতে পারবেন।
২য় বর্ষ ৩য় সংখ্যা এপ্রিল ২০১৮তে যারা কবিতা লিখেছেন তারা হলেন- নাহিদা আশরাফী, বসন্ত বোস, চিরশ্রী দেবনাথ, শামীম নওরোজ, মৌসুমী ম-ল দেবনাথ, রফিক উল ইসলাম, নবনীতা নব, প্রত্যয় হামিদ, ফারহানা হক, শিশির আজম, মাসুদার রহমান, অয়ন সাঈদ, আদ্যনাথ ঘোষ, আল মামুন আব্দুল্লাহ, অরনী চৌধুরী, এম. আব্দুল হালীম বাচ্চু, নুরুল ইসলাম বাবুল, মেহেজাবীন নেছ প্রমুখ। কবিতাগুলি সুপাঠ্য এবং ভাষা শৈলীর দিক থেকে প্রশংসার দাবী রাখে। কবিতা নির্বাচনে সম্পাদকের আপোষহীন মনোভাবের পরিচয় যথাযথভাবে পরিদৃষ্ট।
পরিশেষে বলবো, যেই ম্যাগাজিন পুরনো মূল্যবোধকে আক্রমণ করতে পারবে না তাকে আমরা প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন বলতে পারি না। লিটল ম্যাগাজিনের যে সকল বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয় বলে সন্দীপ দত্ত তাঁর “লিটল ম্যাগাজিন ভাবনা” গ্রন্থে লিটল ম্যাগাজিন প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, তূর্য নিনাদ সাহিত্য ম্যাগাজিন সেই সকল বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেই এগিয়ে চলেছে। তূর্য নিনাদ সম্পাদক মির্জা রানা খুব যতেœর সাথে সর্বজন স্বীকৃত লিটল ম্যাগাজিনের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ রেখে, বস্তুবিশে^র ভোগ প্রতিযোগিতাকে পাশ কাটিয়ে গণমানুষের পক্ষের একটি একটি কাগজ হিসেবে পত্রিকাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটি নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন। পাঠকবৃন্দের জ্ঞাতার্থে সন্দীপ দত্ত লিখিত লিটল ম্যাগাজিনের বৈশিষ্ট্যগুলি নি¤েœ উল্লেখ করা হলোঃ
১) যে কোন দেশ ও জাতির সাহিত্য সংস্কৃতির প্রধান ধারক ও বাহক সেই দেশের লিটল ম্যাগাজিন।
২) লিটল ম্যাগাজিনের অবস্থান ‘বিগ ম্যাগাজিনের’ ঠিক বিপরীতে।
৩) লিটল অর্থাৎ কম পুঁজিতে বৃহৎ চিন্তার প্রকাশ।
৪) লিটল ম্যাগাজিনের নিজস্ব লেখকগোষ্ঠী থাকে ও লেখক তৈরি করে।
৫) লিটল ম্যাগাজিন যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে।
৬) নিরপেক্ষ ও নির্ভীক বক্তব্য তুলে ধরে সমাজ ও সাহিত্য বিশ্লেষণ করে।
৭) লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে চালিত ও সংগঠিত করে।
৮) লিটল ম্যাগাজিনের উদ্দেশ্য সৃজনশীল সাহিত্যের প্রসার।
৯) লিটল ম্যাগাজিনকে বলা যায় তারুণ্যের সাহিত্য বা সাহিত্যের তারুণ্য।
১০) লিটল ম্যাগাজিনেই সাহিত্যের বহু কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে থাকে।
১১) লিটল ম্যাগাজিন যথার্থ অর্থে সাহসী পত্রিকা। যে কোন বক্তব্য (সাহিত্য-সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ) প্রকাশে নিদ্বির্ধ। লেখার ব্যাপারে কোন রফা বা আপস করে না।
১২) প্রতিষ্ঠিত, বাজারী ও ব্যবসায়ী লেখক কিংবা লেখা ব্যবসায়ীর স্থান লিটল ম্যাগাজিনে নয়।
১৩) কাগজের বিশেষ চরিত্র গড়ে তোলা লিটল ম্যাগাজিনের অন্যতম শর্ত।
১৪) লিটল ম্যাগাজিন সমাজের কাছে দায়বদ্ধ।
১৫) লিটল ম্যাগাজিন বিশেষ উদ্দেশ্যবাহী।
১৬) লিটল ম্যাগাজিন যে কোন বিষয়ের হতে পারে। যথা- কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, ধ্রুপদী সাহিত্য, শিল্পকলা, অনুবাদ, লোকসংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব¡, দর্শন, সমালোচনা ইত্যাদি।
১৭) লিটল ম্যাগাজিন সর্বাঙ্গীন সাংস্কৃৃতিক ও সাহিত্যিক আন্দোলন।
১৮) লিটল ম্যাগাজিন যে কোন আয়তনের হতে পারে। নির্দিষ্ট কোন মাপ নেই। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩০০ হতে পারে, ১ পৃষ্ঠাও হতে পারে। তবে সাধারণভাবে ২ থেকে ৫-৬ ফর্মা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
১৯) ঝকঝকে, ঝকমকে গ্ল্যামার না থাকলেও লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশরীতি ও রুচি মর্যাদাপূর্ণ।
২০) লিটল ম্যাগাজিনের অন্য প্রচেষ্টা- ‘নিজস্ব প্রকাশনা’।
২১) লিটল ম্যাগাজিনের দুটি দিক (১) সৃজনশীলতা (২) প্রতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিরপেক্ষ ও নির্ভীক প্রকাশ।
২২) নির্দিষ্ট পাঠক গড়ে তোলে। পাঠককে সাহিত্যের পাঠে দীক্ষিত করে নতুনভাবে।
২৩) সমসাময়িক ঘটনার ¯্রােতে লিটল ম্যাগাজিন উজ্জীবিত।
২৪) বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের প্রবণতা।
২৫) জাতীয় জীবনে কোন সাম্প্রতিক সমস্যা বা জ্বলন্ত বিষয় নিয়ে জনমত গড়ে তোলা।
২৬) আন্তর্জাতিক সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন প্রভৃতি বিষয়কে পত্রিকা মারফত প্রকাশ করা।
২৭) সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে স্পর্শ করা।
২৮) সাহিত্য সম্মেলনের নিয়মিত আয়োজন।
আদর্শ লিটল ম্যাগাজিনের এই বৈশিষ্ট্যগুলোর নিরীখে অনায়াসে বলা যায়, মির্জা রানা সম্পাদিত তূর্য নিনাদ একটি আদর্শ লিটল ম্যাগাজিন। আর্ট পেপারে রঙিন মলাটের ৯ ফর্মার তূর্য নিনাদ ১০০ গ্রাম অফসেট সাদা কাগজে ঝকঝকে ছাপা, মনোরম বাঁধাই সংখ্যাটিকে সংগ্রহে রাখার মতো করে তুলেছে। তূর্য নিনাদ ও মির্জা রানা এগিয়ে যাক দীপ্ত পদক্ষেপে এটাই কামনা।
No comments:
Post a Comment